https://t.me/DrAkramNadwi/6142
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
|| প্রশ্ন:
দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার একজন ছাত্র নিম্নোক্ত প্রশ্ন করেছেন:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু,
আশা করি আপনার শরীর ও মন ভালো আছে।
: কুরআন অধ্যয়ন, তাতে তাদাব্বুর (গভীর চিন্তা) ও তাফাক্কুর (চিন্তা-গবেষণা) করার পদ্ধতি ও পর্যায় কী কী? কুরআন বোঝার এবং তাতে গভীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের জন্য (ভাষার বাইরে) কী কী জিনিস অপরিহার্য এবং কোন কোন বই পড়া প্রয়োজন? আমি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছি, এই বছর শরিয়াহ বিভাগে পড়ছি, কুরআনের প্রতি রুচি গড়ে তুলতে চাই এবং কিছুটা সময় নিয়মিতভাবে এর জন্য দিতে চাই। অনুগ্রহ করে আমাকে দিকনির্দেশনা দিন।
ওয়াকার আহমদ,
মুরওয়াস, নিকটবর্তী ভোপাল (মধ্যপ্রদেশ)
ছাত্র, দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা, লক্ষ্ণৌ
|| উত্তর:
আপনার প্রশ্নে হৃদয় খুশি হয়েছে। এই পতন ও বস্তুবাদী যুগে আল্লাহর কিতাবের প্রতি আগ্রহ সৌভাগ্যের লক্ষণ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে এবং আমাদের সকলকে এই বরকতময় হিদায়তের ঝরনাধারার মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন—আমীন।
আমি কুরআন সম্পর্কে উর্দু, আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় বহু প্রবন্ধ লিখেছি। আপনি সেগুলো অধ্যয়ন করুন। হতে পারে এখানে যেসব বিষয় আমি বলছি তা ছাড়া অন্য কিছু সেগুলোতে পাবেন। এই মুহূর্তে আমি কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি:
প্রথম কথা:
মনে রাখুন, কুরআন অধ্যয়ন ও তাদাব্বুরের উদ্দেশ্য আপনার নিজের আত্মার সংশোধন। ভাবুন, আমার প্রভু আমার পথনির্দেশের জন্য এই কিতাব নাজিল করেছেন, আমি কীভাবে তা পড়ব, তার ওপর চিন্তা করব, তার গভীরে প্রবেশ করব, যাতে আমার ঈমান প্রতিদিন বৃদ্ধি পায়, আমার আমল শুদ্ধ হয়, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং আখিরাতের প্রতি আগ্রহ জন্মে, এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
অনেকেই কুরআনের জগতে প্রবেশ করেছেন যাদের দৃষ্টি সংশোধন বা আত্মশুদ্ধির দিকে নয়; বরং তারা কুরআনকে একটি প্রভাবশালী গ্রন্থ হিসেবে পড়েন এবং তার প্রভাবশীলতার কারণগুলো ব্যাখ্যা করে বেড়ান। মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলা এই কিতাব তাঁর সৃষ্টি-জগৎকে মুগ্ধ করার জন্য নাজিল করেননি। আমরা যদি দিনরাত আল্লাহর কিতাবের প্রশংসা করি, তার মু‘জিযা (অলৌকিকতা) বর্ণনা করতে থাকি, তবু আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না। হ্যাঁ, যদি আমরা এই কিতাব অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে শুরু করি, তাহলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন এবং আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টার জন্য অপরিমেয় সওয়াব দান করবেন।
দ্বিতীয় কথা:
যদিও আপনি আরবি ভাষা ব্যতিরেকে কথা বলেছেন, তবুও আমি আপনাকে আরবি ভাষার প্রতি মনোযোগ দিতে অনুরোধ করব। আপনি এখনও ছাত্র, অলসতা করবেন না। কুরআনের নাজিলের যুগের ভাষায় দক্ষতা অর্জন করুন। মুআল্লাকাত (প্রাক-ইসলামি বিখ্যাত কবিতা) পড়ুন এবং বারবার পড়ুন।
জামহুরাত আশা’র আল-আরব, দিওয়ানে হামসা, দিওয়ানে হাসান বিন সাবিত, এবং ফারাযদাক, জারির ও আখতাল—এই কবিদের দিওয়ান অধ্যয়ন করুন। জাহিলিয়াত যুগের ভাষণ ও প্রবাদ-প্রবচনের প্রতি গভীর নজর দিন।
তৃতীয় কথা:
কুরআনের বক্তা (متكلم)-কে বোঝার চেষ্টা করুন। প্রত্যেক বক্তার একটি নিজস্ব ভঙ্গি থাকে। আল্লাহ তাআলার বাণীর ধরন সৃষ্ট জীবদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কথার সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলুন। কখনও তিনি রব ও বাদশাহর রূপে কথা বলেন, তখন ‘আমরা’ (نحن) শব্দ ব্যবহার করেন। কখনও তিনি ইলাহ ও উপাস্য হিসেবে কথা বলেন, তখন ‘আমি’ (أنا) শব্দ ব্যবহার করেন। কখনও তিনি নবীদের কথা বর্ণনা করেন, মাঝখানে নিজের বক্তব্য ঢুকিয়ে দেন। কখনও তিনি কাফের ও মুশরিকদের কথা তুলে ধরেন এবং স্থান-কাল অনুযায়ী তাদের ওপর মন্তব্য করেন।
এই সমস্ত বিষয় একে অপরের সাথে সংযুক্ত, সুরেলাভাবে আবদ্ধ। প্রতিটি এমন স্থানে থামুন, প্রতিটি বক্তব্যের বক্তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। এতে আপনার জন্য হিকমতের নতুন নতুন দরজা উন্মুক্ত হবে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাব বোঝার জন্য মানুষের সেই ক্ষমতার উপর নির্ভর করেছেন, যা তিনি মানুষকে দান করেছেন—এগুলো হলো প্রকৃতি (ফিতরাত) এবং বুদ্ধি (আকল)। আপনার ফিতরাতকে জাগ্রত করুন, এবং প্রতিটি বিষয়ে বুদ্ধি ব্যবহার করুন। ফিতরাত ও বুদ্ধি সম্পর্কে আমার প্রবন্ধগুলো পড়ুন। এই দুই ক্ষমতা কাজে না লাগানোর পরিণাম হলো গ্রিক যুক্তি ও দর্শনের আশ্রয় নেওয়া, যার ফলে মানুষ আকীদা ও কালামের এমন সব বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে যা অহেতুক, এবং যা ওহির স্বচ্ছ মুখাবয়বকে ম্লান করে দেয়। আল্লাহর কিতাবকে তার উচ্চতা থেকে নামিয়ে এনে দার্শনিক, মু‘তাযিলা, আশআরী ও মাতুরিদিদের নিচু ভূমিতে নামানোর সেই ভয়ংকর অপরাধ থেকে বেঁচে থাকুন।
চতুর্থ কথা:
চিন্তা করুন—আল্লাহ তাআলা কী বললেন এবং কী বলেননি? যা বলেছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যা বলেননি, সেটি গুরুত্বহীন। তাফসিরের বইগুলো এমন অনেক কথায় ভরপুর, যা আল্লাহ তাআলা উপেক্ষা করেছেন। এর পরিণতি হলো—এই বইগুলো উপকথার সংগ্রহে পরিণত হয়েছে। এসবের মধ্যে এমন কথাও রয়েছে, যা নবীদের অবমাননার সমতুল্য।
পঞ্চম কথা:
আপনি মাওলানা হামিদউদ্দীন ফারাহী রহ.-এর সমস্ত বই সংগ্রহ করুন এবং একটি নির্ধারিত ধারাবাহিকতায় তা অধ্যয়ন করুন—এই ধারাবাহিকতা আমি আমার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। পাশাপাশি শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর “আল-ফাওযুল কাবীর”, ইমাম ইবনু তাইমিয়ার “মুকাদ্দিমাহ ফি উসূলিত তাফসীর”, এবং ইমাম যমাখশারীর “আল-কাশশাফ”—এই গ্রন্থগুলো বারবার পড়ুন। এবং মৃত্যু পর্যন্ত কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক কখনও ছিন্ন করবেন না।
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।