এছাড়াও, সহিহ বুখারির ক্ষেত্রে নারীদের সনদই সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। সাধারণত দেওবন্দ, নদওয়া ও অন্যান্য মাদরাসার সনদে ইমাম বুখারি পর্যন্ত পৌছতে বিশ বা তারও বেশি মধ্যবর্তী ব্যক্তির নাম থাকে। অথচ আয়িশা মাকদিসিয়্যা (মৃত্যু: ৮১৪ হিজরি)–এর সনদের মাধ্যমে আমার ও ইমাম বুখারির মধ্যে মাত্র চৌদ্দটি মধ্যবর্তী নাম আছে। ইমাম বুখারির ইন্তিকাল হয়েছিল ২৫৬ হিজরিতে, আর এখন ১৪৪০ হিজরি। প্রায় বারো শত বছরের ব্যবধানে মাত্র চৌদ্দটি ওয়াসিতার মাধ্যমে ইমাম বুখারির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া সত্যিই সর্বোচ্চ স্তরের সনদের উদাহরণ।
বড় বড় ইমামদের নারী শিক্ষকেরা,
শুরু থেকেই হাদিস ও ফিকহের বিশিষ্ট ইমামরা বিপুল সংখ্যক নারীর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারির শিক্ষক মুসলিম ইবনে ইবরাহিম ফারাহিদি এবং আবু-ল-ওয়ালিদ তায়ালিসি শুধু বাসরা শহরেই সত্তরজন নারীর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছিলেন। হাফিজ সামআনি তাঁর ৬৮ জন নারী শিক্ষকের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের জীবনী সংরক্ষণ করেছেন। ইবনে আসাকির তাঁর মু‘জামুশ শুইখ গ্রন্থে ৮০ জন নারী শিক্ষকের জীবনী লিখেছেন এবং বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁদের কাছ থেকে বর্ণনা সংগ্রহ করেছেন।
তদ্রূপ ইমাম মাজ্জি, ইবনে তাইমিয়া, বরযালি, যাহাবি, ইরাকি, ইবনে হজর, সাখাবি, সুয়ুতি প্রমুখেরও বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষক ছিলেন। ইবনে নাজ্জার— যিনি খতিব বাগদাদির তারিখ–এর উপর সংযোজন লিখেছেন— তিনি ছয়শো পুরুষ ও চারশো নারীর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ তাঁর যুগে জ্ঞানচর্চাকারীদের অন্তত চল্লিশ শতাংশই ছিলেন নারী। বরং ধারণা করা হয়, নারীদের সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি ছিল, কারণ নারীদের সম্পর্কে তথ্য সাধারণত কম নথিভুক্ত হতো।
আজও বহু হাদিসগ্রন্থ ও অগণিত অংশ কেবল নারীদের বর্ণনার মাধ্যমেই সংরক্ষিত আছে। যেমন— ইমাম তাবরানির আল-মু‘জামুল কবির (২৫ খণ্ডে সমাপ্ত) ফাতিমা আল-জুজদানিয়্যা (মৃত্যু: ৫২৪ হিজরি)–র বর্ণনার মাধ্যমে প্রচলিত।
ফিকহেও নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা অনেক বিষয়ে নারীদের প্রদত্ত ফতোয়ার অনুসরণ করেছেন। সাহাবিয়াতের পর খ্যাতনামা নারী ফকিহদের মধ্যে আছেন— উম্মে ‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান, হাফসা বিনতে সিরীন, মুআযা আল-আদাওয়িয়া, উম্মে দারদা, ফাতিমা বিনতে আল-মুনযির ইবনে যুবায়ের প্রমুখ।
হানাফি মাযহাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো আলাউদ্দিন সামারকন্দির তুহফাতুল ফুকাহা। তাঁর কন্যা শুধু এই বইয়ের পণ্ডিতাই ছিলেন না, বরং পুরো গ্রন্থটি মুখস্থ জানতেন। সামারকন্দির শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা কাসানি ছিলেন। কাসানি যখন ফিকহশাস্ত্রের শিক্ষা সম্পন্ন করলেন, তখন তিনি তাঁর শিক্ষক সামারকন্দির কাছে কন্যার সাথে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সামারকন্দি বললেন— “আমার কন্যা ফিকহে বিশেষজ্ঞ, তুমি এখনো তার মর্যাদার সমকক্ষ হওনি। তুমি আমার গ্রন্থের উপর একটি ব্যাখ্যা লিখো, যদি সেটি আমার পছন্দ হয়, তবে আমি তাকে তোমার সাথে বিয়ে দেব।”
অতঃপর কাসানি বদায়েউস সানায়ে নামে ব্যাখ্যা রচনা করলেন। এটি সামারকন্দির নিকট অত্যন্ত প্রিয় হলো এবং তিনি কন্যার বিবাহ তাঁর সাথে দিলেন। ঐতিহাসিকরা বলেন— “শরহু তুহফাতিহি ওয়া তাযাওয়ুজা বিনতাহু” (অর্থাৎ: তিনি তার গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখলেন এবং কন্যাকে বিয়ে করলেন)। পরবর্তীতে হালাবের আমির কাসানিকে হালাবের একটি কলেজে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি সেখানে পাঠদান শুরু করেন। তাঁর ছাত্র ইবনে আল-আদিম আল-হালাবি প্রমুখ বলেন— “কাসানি আমাদের ফিকহ পড়াতেন, আমরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হতাম। মাঝে মাঝে কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে বলতেন, তোমরা অপেক্ষা করো, আমি একটু পরে আসছি। এরপর ফিরে এসে উত্তর দিতেন। পরে আমরা জানতে পারি, তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতিমার কাছে জিজ্ঞেস করে এসে আমাদের উত্তর দিতেন।”
কাসানির বদায়েউস সানায়ে সম্পর্কে হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গুহী রহ. বলেছেন— এটি হানাফি মাযহাবের সর্বোত্তম গ্রন্থ। বিস্ময়ের বিষয় হলো— হানাফি মাযহাবের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বই রচিত হয়েছিল এক মহীয়সী নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, আর যিনি এটি রচনা করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ফিকহে স্বামীর চেয়ে অধিক জ্ঞানী ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুগ থেকে শুরু করে বহু শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত রীতি ছিল, নারীরা মসজিদে অনুষ্ঠিত পাঠচক্রে অংশ নিতেন এবং পাঠদান করতেন। শাম, ইরাক, মিসর ও ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মসজিদগুলোতে যেমন পুরুষরা শিক্ষা দিতেন ও গ্রহণ করতেন, তেমনি নারীরাও শিক্ষা দিতেন ও গ্রহণ করতেন।
ইসলামে সর্বাধিক পবিত্র তিনটি মসজিদ— মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা— এই তিনটিতেই নারীরা দারস দিতেন। তাঁদের পাঠচক্রে নারী-পুরুষ উভয়েই অংশ নিতেন। বরং অনেক সময় পুরুষ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি হতো। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলেম, মুহাদ্দিস, ফকিহ এবং কাজিরা।