AkramNadwi

এই দলাদলি, সন্দেহ ও বিভাজনে পূর্ণ পরিবেশে

এই দলাদলি, সন্দেহ ও বিভাজনে পূর্ণ পরিবেশে
রেওয়ায়াতের আসর হাজির হয় এমন কোনো নতুন মতভেদ সৃষ্টি করতে নয়,
নয় কোনো নতুন বিতর্কের দরজা খোলার জন্য,
বরং হাজির হয় সে কাজটি সম্পন্ন করতে,
যা বিদ্যালয় ও কিতাবগুলো করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এগুলো একত্রিত করে দেয় বিচ্ছিন্নদের,
এক আসরে বসায় মতপার্থক্যকারীদের।
এখানে তারা কোনো দ্বিমতপূর্ণ মাসআলা নিয়ে বিতর্ক করে না,
না কোনো আক্বীদাগত তর্কে জড়ায়,
বরং তারা সবাই একত্র হয় এক পবিত্র উৎসের কাছে—
আর সেই উৎস – রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর হাদীস।

সেখানে একজন তাঁর শায়খ থেকে শোনা একটি হাদীস বর্ণনা করেন সনদসহ,
এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয়জনও তাকে অনুসরণ করেন,
আর সবাই একত্র হন বরকত ও সনদের উদ্দেশ্যে।

এখানেই পরিচয় হয়,
দূরত্ব ঘুচে যায়।

এখানে হানাফি মাতুরিদি বসেন মালিকি আশআরির পাশে, তাঁর বিপরীতে থাকেন হাম্বলি সালাফি, সঙ্গে থাকেন শাফেয়ি আশআরি, আর একজন সুফিও যিনি ভিন্ন ভাষাতত্ত্বিক পদ্ধতির অনুসারী—যা বাকিদের থেকে আলাদা।

তবু তারা কেউ কারও দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকায় না,
কেউ কাউকে শত্রুর মতো এড়িয়ে চলে না।

বরং তারা একে অপরকে সালাম দেয়, হাসিমুখে কথা বলে, আদব ও বিনয়ের সঙ্গে আলাপ করে এবং অন্তর থেকে অনুভব করে— যদিও মতভেদ আছে, তবু লক্ষ্য তো এক।

হয়তো কখনো তাদের মধ্যে আলোচনা হয়, কখনো তা তীব্রও হয়ে পড়ে,
কিন্তু তখনই সবাই স্মরণ করে আল্লাহর বাণী—
“নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পরের ভাই।”
আর রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর বাণী—
“সেই ব্যক্তি মুসলিম, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।”

ফলে মন ও আত্মা প্রশান্ত হয়,
আর প্রত্যেকেই ফিরে যায় নিজের আসনে,
মন ভরে এমন এক স্বচ্ছতা নিয়ে,
যা সে আগমনের সময় অনুভব করেনি।

এই আসরগুলো,
যদিও বাহ্যিকভাবে একটানা সনদ ও হাদীস পাঠের অনুষ্ঠান বলে মনে হয়,
তবু বাস্তবে এগুলো এক ধরনের তারবিয়াহ (নৈতিক গঠন),
একটি সামাজিক ওষুধ,
এবং এমন এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন
যা মানুষের হৃদয়ে এমন প্রভাব ফেলে—
যা অনেক সময় বক্তৃতা বা প্রথাগত ক্লাস দিয়ে সম্ভব হয় না।

এগুলো শুধু বর্ণনা বা সংরক্ষণের কাজেই সীমাবদ্ধ নয়,
বরং এগুলো মানুষের অন্তরে পরিবর্তন ঘটায়,
বিভিন্ন মতের লোকদের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন রূপ গড়ে তোলে।
কিন্তু সেটি না কোনো জোরজবরদস্তির ভিত্তিতে,
না কোনো পক্ষের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে—
বরং ভালোবাসা ও সহনশীলতার ভিত্তিতে,
এই বিশ্বাস নিয়ে যে ভিন্নতা আল্লাহর সৃষ্টির একটি সুন্নত।

আমি নিজে বেড়ে উঠেছি নদওয়াতুল উলামা-এর পরিবেশে—
যেখানে আমি “মিতব্যয়িতা ও ভারসাম্যের স্বাদ” পেয়েছি,
এবং সেই প্রশস্ততার অর্থ বুঝেছি—
যা মতভেদকে অস্বীকার করে না,
তবে তাকে লড়াইয়ের ময়দানেও পরিণত হতে দেয় না।

এই রেওয়ায়াতের আসরগুলোতে আমি এমন অনেকজনের সঙ্গে একসাথে বসেছি—
যাদের সঙ্গে আমার ফিকহে, আক্বীদায়, এমনকি রাজনীতিতেও মতপার্থক্য রয়েছে—
তবুও আমার হৃদয়ে তাদের জন্য ভালোবাসা আরও বেড়েছে,
তাদের সঙ্গে আবারও দেখা করার আগ্রহ জন্মেছে,
এবং সেই মানুষদের জন্য করুণা অনুভব করেছি,
যারা এমন এক পরিষ্কার ও পবিত্র পরিবেশ থেকে বঞ্চিত।

দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন মাযহাবের উলামা ও তালিবুল ইলমদের সাহচর্যে থাকার পর,
আমি এখন বুঝি—
আমি মুসলমানদের সবাইকে ভালোবাসি,
এই কারণে নয় যে তারা আমার মতো,
বরং এই কারণে যে আমার রব আমাকে তাই করতে বলেছেন।
এবং আমি বুঝি, তাদের প্রতি এই ভালোবাসার মাধ্যমেই
আমি আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারি।

তাদের ভিন্নতা আমাকে সংকীর্ণতার দিকে ঠেলে দেয় না,
বরং আমাকে প্রশস্ততার সুযোগ দেয়,
সংঘাতের নয়—সম্প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।

সুতরাং, আমি যা এক সময় মনে করতাম শুধুই বাহ্যিক এক রূপ—
আজ তা আমার কাছে হয়ে উঠেছে গভীর এক অন্তরসার,
যা মানুষের চরিত্রকে সংশোধন করে।

আমি যা একসময় ভাবতাম শুধুই এক আনুষ্ঠানিকতা,
আজ তা আমার দৃষ্টিতে মনকে গঠনের, অন্তরকে নরম করার ও মানুষকে কাছে আনার এক উপায়।

এখন রেওয়ায়াতের এই আসরগুলো আমার কাছে
শুধু একটি জ্ঞানগত মাধ্যমই নয়,
বরং একটি মানবিক প্ল্যাটফর্ম,
যা আবারো ইলমকে তার আসল তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়,
মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও একতাবোধ জাগিয়ে তোলে।

এবং আমার দৃষ্টিতে—
এবং সত্যিকার জ্ঞানপিপাসুদের দৃষ্টিতেও—
এটাই হলো শরিয়তের অন্যতম উচ্চতম উদ্দেশ্য,
এবং ইলম অন্বেষণের সবচেয়ে সম্মানজনক লক্ষ্য।

——————–
ক্যাটাগরি : শিক্ষা, ইসলামি চিন্তাধারা, আত্মশুদ্ধি।

✍ মূল: ড. মোহাম্মাদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।
—-
যে আর্টিকেল থেকে অনূদিত, তার লিংক👇
https://t.me/DrAkramNadwi/6637

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *