AkramNadwi

ইহসান ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/2932
بسم الله الرحمن الرحيم.

:: নদওয়ায় ছাত্রজীবন এবং শিক্ষকতার সময়ে কখনও কখনও রমজান মাসে তাকিয়া, রায়বেরেলি যাওয়ার সুযোগ হতো। সেখানে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর সান্নিধ্য লাভ করতাম, তাঁর ব্যবহারিক জীবন থেকে শিক্ষা নিতাম, তাঁর উপদেশাবলী অজ্ঞতার পর্দা সরিয়ে দিত। সেই পরিবেশে আত্মার পরিশুদ্ধতার এক অনন্য ব্যবস্থা ছিল। মনে হতো যেন অন্তরের শান্তি এখানেই রয়েছে। তাকিয়ার অন্যান্য বাসিন্দা এবং আগত সম্মানিত অতিথিদের সঙ্গ থেকেও উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেতাম।

সেই সময়ে সেখানে একজন অন্ধ প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, সাইয়্যেদ ইসমাঈল হাসানী। তিনি ইংরেজি ভাষায় খুব দক্ষ ছিলেন। কোনো সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন এবং অবসর গ্রহণের পর বাড়িতেই থাকতেন। তার চোখে ছানির সমস্যা দেখা দেয়, অপারেশন করান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয় এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই বার্ধক্যে তিনি তাকিয়ার মসজিদে আযান দিতেন এবং ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন।

আমি তাঁর কাছে বসতাম এবং তাঁর কথাবার্তায় মুগ্ধ হতাম। তিনি আমার ভাই মকরম আফতাব আলম আজমি নদভীর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা পোষণ করতেন এবং প্রায়ই তাঁর প্রশংসা করতেন। যখন তিনি জানলেন যে আফতাব সাহেব আমার বন্ধু, তখন তিনি আরও বেশি তাঁর উল্লেখ করতে লাগলেন। আমি তাকিয়ার কিছু পরিচিত ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করলাম যে, আফতাব সাহেবের প্রতি এতটা সম্পৃক্ত কেন, যদিও তিনি বাহ্যিক চোখে তাঁর আচার-আচরণ বা চরিত্র দেখতে সক্ষম ছিলেন না।

তদন্ত করার পর জানা গেল, একবার হযরত মাওলানা রহ.-এর সেবা করার জন্য আফতাব সাহেব তাকিয়ায় কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, ইসমাঈল সাহেব একাকী বসে থাকেন। তাই তিনি তাঁর কাছে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলতেন, নিজের কথা বলতেন এবং তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এ কারণেই ইসমাঈল সাহেব তাঁর প্রতি অন্তরের সম্পর্ক অনুভব করেন এবং সবসময় তাঁকে স্মরণ করতেন।

আরবি ভাষার যে শব্দগুলো উর্দুতে স্থানান্তরিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু শব্দের অর্থ বদলে গেছে এবং কিছু অর্থ সংকুচিত হয়ে গেছে। এরকম একটি শব্দ হলো ‘ইহসান’। উর্দুতে এর অর্থ হলো বিনা পারিশ্রমিকে কারও সাহায্য করা। অথচ আসল আরবিতে এ শব্দের অর্থ আরও বিস্তৃত। এটি ‘হুসন’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘হুসন’ বলতে সৌন্দর্য বোঝায়, তা বাহ্যিক হোক বা অভ্যন্তরীণ। ‘ইহসান’ শব্দের অর্থ হলো কোনো জিনিসকে সুন্দর করে তোলা, তা শোভিত করা এবং তা সৌন্দর্য প্রদান করা।

এই পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ স্বার্থের জন্য সম্পর্ক গড়ে তোলে। যতক্ষণ আপনার সাথে তাদের স্বার্থ জড়িত থাকবে, ততক্ষণ তারা আপনার বন্ধু থাকবে। আর যখন স্বার্থ শেষ, বন্ধুত্বও শেষ। বন্ধুত্বের গভীরতা ও স্থায়িত্ব স্বার্থের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। এই ধরনের সম্পর্কগুলোতে বিশ্বস্ততা একটি অর্থহীন শব্দ। কোমল অনুভূতিগুলো মৃত হয়ে যায় এবং এর আসল চালিকা শক্তি অর্থাৎ ভণ্ডামি খুব দ্রুত প্রকাশ পেয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্বার্থবাদ একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি। অনেক মুসলিম প্রশ্ন করেন, আমেরিকা সব অবস্থায় ইসরায়েলের সমর্থন করে কেন? এর সহজ উত্তর হলো ইসরায়েলের সমর্থন আমেরিকার স্বার্থে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মুসলিম নেতারাও একই রোগে আক্রান্ত। বরং অনেক আলেমের কথা ও কাজের ভিত্তি স্বার্থপরতা ও খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করে।

কতটা করুণ সেই জাতি, যার নেতা জুয়াড়ি ও জুয়া খেলা পরিচালনাকারী হয়!
যে সম্পর্ক স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে ইহসান বলা যায় না, যদিও সাহায্য ও সহায়তার উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দেওয়া হোক। যখন সম্পর্কগুলো স্বার্থহীন হয়, পারস্পরিক সম্মানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং দয়া প্রদর্শন করার চেষ্টাকে গোপন রাখা হয়, তখন এগুলোর মধ্যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। এই ইহসান আল্লাহর ইবাদতে যেমন কাম্য, তেমনই আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।

অনেক মানুষ তখনই ইবাদতে মনোযোগ দেয়, যখন তারা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু যখন তাদের সমস্যা দূর হয়ে যায়, তখন তাদের ইবাদতে দুর্বলতা আসে। অথচ সেই ইবাদতই গ্রহণযোগ্য, যেখানে আল্লাহভীতি থাকে, তাঁর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকে এবং যেখানে কোনো তাড়াতাড়ি লাভের প্রত্যাশা থাকে না। প্রথমটি তাকওয়া এবং দ্বিতীয়টি সবর হিসেবে পরিচিত। এই দুয়ের সমন্বয়কেই ইহসান বলা হয়।

কুরআন মজিদে কখনো কখনো শুধুমাত্র তাকওয়া বা শুধুমাত্র সবরকেও ইহসান বলা হয়েছে, কারণ তাকওয়া এবং সবরের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান।

লেনদেনের ক্ষেত্রে ইহসানের অর্থ হলো, আল্লাহর বান্দাদের উপকার করার অভিপ্রায় থাকা, তাদের থেকে উপকার গ্রহণ করার নয়। উপকার করার একটি রূপ হলো আর্থিক সহায়তা, তবে ইহসান এতে সীমাবদ্ধ নয়। আপনি কারও ভালো কাজ শেখান, তাকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখেন, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন, তার সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলেন, তার দুঃখ লাঘব করেন এগুলো সবই ইহসানের বিভিন্ন রূপ। এর মধ্যে

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হাসি-তামাশাও অন্তর্ভুক্ত, তবে তা যন্ত্রণা দেওয়া বা বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত নয়।

যখন হজরত ইউসুফ (আ.) জেলে ছিলেন, তখন তিনি সম্পদহীন অবস্থায় ছিলেন। তাঁর এমন অবস্থা ছিল না যে, কারও আর্থিক সহায়তা করতে পারেন। তবুও জেলের লোকেরা তাঁর ইহসানের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বলেছিল, “إنا نراك من المحسنين” (নিশ্চয়ই আমরা আপনাকে ইহসানকারীদের মধ্যে একজন দেখি)। ইউসুফ (আ.) জেলে ইবাদতের পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে ভালোভাবে ব্যবহার করতেন, তাদের কথা শুনতেন, তাদের সঙ্গে বসতেন এবং তাদের সৎ কাজ শেখাতেন।

ইহসান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ। এর মূলকথা হলো, আমরা মানুষের উপকার করার চেষ্টা করব, তাদের থেকে উপকার নেওয়ার নয়; অন্যদের সেবা করব, তাদের থেকে সেবা নেওয়ার নয়; বন্ধু ও শত্রু উভয়ের দুঃখ লাঘব করব এবং সবার কাজে আসব। ইহসানের নিম্নতম স্তর হলো, কাউকে কোনো ক্ষতি না করা।

সুন্দর সেই নয়, যে বাহ্যিক প্রসাধনে নিজেকে সাজায়; বরং সুন্দর সেই, যে নৈতিকতা ও চরিত্রের ঊর্ধ্বতন গুণাবলিতে সজ্জিত। সুন্দর তাঁরা, যাঁদের সৌন্দর্য কাঁটার মাঝে এমনই দীপ্তিময় থাকে, যেমনটি বাগান ও ফুলবনে থাকে। তাঁদের সৌন্দর্য সরলতা ও দারিদ্র্যতায়ও স্থায়ী থাকে। তাঁরা শীতল প্রকৃতির মতোই বসন্তকালে যেমন ফোটেন, তেমনি ঝরাপাতার ঋতুতেও।

সারকথা হলো, আপনি অন্যদের থেকে এ প্রত্যাশা করবেন না যে, তারা আপনাকে ভালোবাসবে বা সম্মান করবে। বরং নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলুন, যাতে আপনি ভালোবাসার যোগ্য হয়ে ওঠেন। আর সত্যিকারের ভালোবাসা বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য থেকে আসে। এজন্য নিজের মধ্যে একটি স্পন্দিত হৃদয় তৈরি করুন, নিজেকে অসহায়দের সাহায্যকারী এবং দুঃখীদের সঙ্গী বানান। তখন আপনিই প্রতিটি সমাবেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবেন এবং প্রতিটি সভায় আপনার বন্দনা হবে।

———

# আলোচনা # শিক্ষা

লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *