AkramNadwi

ইসলামে উল্লেখিত রিবা কি প্রকৃতপক্ষে রিবা ? ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/3816

কয়েক দিন আগে আমি “রিবা আল-জাহিলিয়া এবং রিবা আল-ইসলাম”

“এই বিষয়টি কখনো বোধগম্য হয়নি যে, একটি মজলিসে তিন কিলো নিম্নমানের খেজুর দিয়ে এক কিলো উন্নতমানের খেজুর নেওয়া হলে
এতে সুদ, সুদের সন্দেহ, বা সুদের মাধ্যম হিসেবে কোন বিষয় থাকতে পারে?

|| উত্তর :

আমার আনন্দ হচ্ছে যে, সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মে এখনো এমন আহলে ইলিমগণ রয়েছেন যারা এই ধর্মকে কোনো ধাঁধা মনে করেন না এবং না বুঝে কোনো কাজ করাকে ধার্মিকতা বলে মনে করেন না। এই ধর্মের বিশেষত্ব এখানেই যে, এর প্রতিটি বিষয় বোঝা এবং বোঝানো সম্ভব। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিষয় সন্তোষজনকভাবে স্পষ্ট না হয়, ততক্ষণ সেটি মানা কোনো ঈমানদার বা বুদ্ধিমান ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক নয়। বরং, সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আলোচনা ও গবেষণা চালিয়ে যাওয়াই প্রয়োজন।

|| রিবা কী ?

রিবার সম্পর্ক ক্রয়-বিক্রয় (বাই‘) এর সাথে নয়; বরং এটি ঋণ (কর্য) এর সাথে সম্পর্কিত। ঋণ দেওয়া একটি কল্যাণমূলক কাজ, যা মানবসমাজে সম্মানের নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ, প্রয়োজনে কাউকে ঋণ প্রদান করা, পরিশোধের ক্ষেত্রে তার অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা এবং ঋণের উপর কোনো ধরনের উপকার আশা না করা—এসবই ঋণের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহর নিকট এভাবে ঋণ প্রদানকারীদের জন্য রয়েছে বিরাট পুরস্কার। এর বিপরীতে, ঋণ দিয়ে সুবিধা লাভ করা একধরনের নীচতা এবং দরিদ্রদের রক্ত শোষণের সমতুল্য। পবিত্র কুরআনে একে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এটিই সেই রিবা, যাকে রিবা আল-জাহিলিয়া বলা হয়। ব্যাংকের সুদও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

|| রিবা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের পার্থক্য :

কোনো সম্পত্তির মালিকানা স্থানান্তরের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন: সদকা, উপহার, ঋণ, উত্তরাধিকার, এবং ওসিয়ত ইত্যাদি। এর মধ্যে একটি পদ্ধতি হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় (বাই‘), যেখানে দুই ব্যক্তি পারস্পরিক পণ্য বা দ্রব্য বিনিময় করেন। প্রাচীনকালে জিনিসের বিনিময়ে জিনিস দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে মুদ্রাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, যা অনেক সহজতর করে দেয়।

ক্রয়-বিক্রয় সাধারণত লাভ অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়। ঋণ কেবল একটি কল্যাণমূলক কাজ, যেখানে লাভ নেওয়া হারাম। অপরদিকে, ক্রয়-বিক্রয় একটি ব্যবসা, যেখানে লাভ অর্জন লক্ষ্য। সমাজে যেমন সদকা ও উপহারের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয়ও অত্যাবশ্যক।

রিবা হলো ঋণের উপর লাভ নেওয়া, আর ক্রয়-বিক্রয় হলো বিনিময়ের উপর লাভ নেওয়া। প্রথমটি নীচতা, আর দ্বিতীয়টি মানব সভ্যতা ও সামাজিক উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ। এই দুইয়ের ভিন্নতা মানব ইতিহাসে সর্বদা স্বীকৃত।

|| সুদখোরদের প্রতারণা :

কিছু সুদখোর ব্যক্তি তাদের নীচতাকে আড়াল করার জন্য রিবা ও ক্রয়-বিক্রয়কে একাকার করার চেষ্টা করেছে। তারা এ ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করেছে যে, যখন আমরা কোনো জিনিস বিক্রি করি, তখন আমরা লাভ নেই। সুদেও লাভ হয়। তাই ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ এক জিনিস। যদি ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয়, তাহলে সুদও বৈধ।

পবিত্র কুরআন তাদের এই যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন:
“তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো রিবার মতো।” (সূরা বাকারা: ২৭৫)

এটি স্পষ্ট যে এটি একটি মাত্র বিভ্রান্তি। কারণ, রিবার সম্পর্ক ঋণের সাথে এবং ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয় দুটি ভিন্ন বাস্তবতা।

|| রিবা আল-ইসলাম :

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন মাজিদ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন। এই গ্রন্থের উপর চিন্তাভাবনার জন্য তিনি আমাদের সবার জন্য একটি আদর্শ। তাঁর সমস্ত সুন্নাহ কুরআন থেকেই প্রাপ্ত।

রিবার নিষিদ্ধতার বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতসমূহের উপর তিনি গভীরভাবে মনোযোগ দেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, রিবার বিষয়টি কতটা গুরুতর। তিনি রিবার প্রতিটি দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি লক্ষ্য করেন যে, রিবাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সর্বদা একটি পথ বেছে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেওয়া হতে পারে। সেটি হলো, রিবার সব ধরণের বা কিছু ধরণকে ক্রয়-বিক্রয় বলে ঘোষণা করে বৈধ করার প্রচেষ্টা। যারা ইসলামিক ফাইন্যান্স সম্পর্কে জানেন, তারা উপলব্ধি করেন যে, এখানেও ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমেই রিবাকে বৈধ করার চেষ্টা চলছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর ইচ্ছা অনুধাবন করে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে যতই মিল তৈরি করা হোক না কেন, রিবা রিবা-ই থেকে যাবে এবং তা বৈধ হবে না। তবে, যদি ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো ধরন রিবার মতো হয়, তাহলে সেটিও অবশ্যই নিষিদ্ধ হবে।

এই জন্যই তিনি সেই ছয়টি পণ্যের কথা উল্লেখ করেছেন যা আগের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এটিকেই রিবা আল-ইসলাম বলা হয়। এই ছয়টি পণ্যের উল্লেখ করার কারণ হলো, সাধারণত এগুলোতেই ঋণ প্রদান প্রচলিত ছিল। কিছু আলেম রিবা আল-ইসলামকে কেবল এই ছয়টি পণ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তবে অধিকাংশ ফকিহ এগুলোর সাথে অন্যান্য পণ্যকেও কিয়াস (অনুমানের ভিত্তিতে) করেছেন।

|| ইসলামি রিবা কেন রিবা বলে বিবেচিত হয় ?

প্রথমেই এটা ভালোভাবে মনে রাখা উচিত যে, কোরআনে যেই রিবার নিষেধাজ্ঞা এসেছে, সেটি ঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই রিবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, তা বেচা-কেনার (বাই’ বা বাণিজ্যের) সঙ্গে সম্পর্কিত।
তবে পরিষ্কারভাবেই বাণিজ্যে কোনো রিবা থাকে না, কারণ বাণিজ্যের ভিত্তি লাভের ওপর। মানবসমাজে ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই রিবার সম্পর্ক বেচা-কেনার সঙ্গে ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, কী কারণে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাণিজ্যের কিছু রূপকে রিবা হিসেবে চিহ্নিত করলেন? এর কারণ আগেই ইঙ্গিত করা হয়েছে—সুদ এমনই অপবিত্র বিষয় যে, বাণিজ্যের কোনো রূপ যদি সুদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়, তবে সেটিও সুদের মতো নিষিদ্ধ হবে।

|| বাণিজ্যের কোনো রূপ কেন রিবার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে?

এর উত্তর হলো, রিবা সবসময় ঋণের মধ্যেই ঘটে। ঋণের অর্থ হলো, একজন ব্যক্তি যা পণ্য ঋণ দেয়, তা ফিরিয়ে নেওয়ার সময় একই পণ্য ফেরত নিতে হবে। অর্থাৎ যদি সোনা, রূপা বা কোনো মুদ্রা ঋণ দেওয়া হয়, তবে ফিরিয়ে নেওয়ার সময়ও একই বস্তু নিতে হবে। যদি খেজুর ঋণ দেওয়া হয়, তবে খেজুরই ফেরত নিতে হবে।
রিবার ক্ষেত্রে একটি পণ্য একই পণ্য দিয়ে পরিশোধ করতে হয়, তবে তাতে অতিরিক্ত কিছু যোগ করা থাকে। এবং রিবা সবসময় বিলম্বিত (অধারিত) লেনদেন হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একই ধরনের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ঋণের মতোই হয়। তাই একই ধরনের পণ্যের বাণিজ্যে যদি অতিরিক্ত বা বিলম্বিত লেনদেন ঘটে, তবে তা সুদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় হারাম হবে। অর্থাৎ নবীজী উৎসাহিত করেছেন যে, বাণিজ্য যেন মুদ্রার মাধ্যমে হয়। আর যদি মুদ্রা না থাকে, তবে এক ধরনের পণ্য যেন অন্য ধরনের পণ্যের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়।

|| ইসলামি রিবা সরাসরি রিবা নয় :

ইসলামি রিবা আসলে রিবা নয়; বরং রিবার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর এ সাদৃশ্যের কারণেই ইসলামে অনেক বিষয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, অনেক কিছু আছে যা ইহুদিদের বা দাম্ভিক ব্যক্তিদের আচরণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে একই ধরনের পণ্যের বাণিজ্যে অতিরিক্ত যোগ করা বা বিলম্বিত লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ এগুলো সুদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এর পেছনের অন্য উদ্দেশ্য

উপরোক্ত বাণিজ্যের নিষেধাজ্ঞার পেছনে সুদের সাদৃশ্য ছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে। বরং বিলম্বিত বাণিজ্য সুদের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যার বিস্তারিত আগের লেখায় আলোচনা করা হয়েছে।
অতিরিক্ত যোগ করার নিষেধাজ্ঞার একটি উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের শোষণ বন্ধ করা। কারণ দরিদ্ররা যদি ভালো মানের খেজুর উৎপাদন করে, ধনী লোকেরা পরিমাণ বাড়িয়ে তাদের নিম্নমানের খেজুর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারে। দরিদ্রদের কাছে পরিমাণের গুরুত্ব বেশি থাকে, ফলে তারা ভালো মানের খেজুর উৎপাদন করেও সবসময় নিম্নমানের খেজুর খেতে বাধ্য হবে।

আমি এই কারণটি উল্লেখ করেছি, কারণ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এবং অন্যান্যদের রচনায় এটি পাওয়া যায়। তবে নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ হলো রিবার সঙ্গে সাদৃশ্য। এজন্যই এই ধরনের বাণিজ্যকেও রিবা বলা হয়।

—–

মূল : ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *