https://t.me/DrAkramNadwi/5830
بسم الله الرحمن الرحيم.
”
|| আল্লাহ তাআলা বলেন:
“নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, যমীন ও পর্বতমালার প্রতি এ আমানত পেশ করেছি, অতঃপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করেছে এবং এতে ভীত হয়েছে। আর মানুষ তা বহন করেছে। নিশ্চয় সে ছিল অতিশয় যালিম, একান্তই অজ্ঞ। (সূরা আহ্যাব, আয়াত ৭২)
“আমানত” বলতে বোঝানো হয়েছে অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা ও সংরক্ষণ করা। এ আয়াতে এর অর্থ হলো—পৃথিবীতে খিলাফতের দায়িত্ব, যা কোরআনে অন্যত্র সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
“এবং স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছিলেন: আমি পৃথিবীতে এক প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।” (সূরা বাকারা, আয়াত ৩০)
আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর শরিয়তের বিধান অনুযায়ী শাসন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁর আদেশসমূহ কার্যকর করার ভার অর্পণ করেছেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। খিলাফতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই দায়িত্বের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ এটিকে “আমানত” শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে, যা আসমান, জমিন ও পর্বতসমূহ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
মানুষের ওপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, যা খিলাফত ও আমানতের রূপে এসেছে। তাকে জন্মগতভাবে উপলব্ধি, ইন্দ্রিয় ও বিবেকসহ যাবতীয় ক্ষমতা ও উপকরণ প্রদান করা হয়েছে, যা তাকে এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের যোগ্য করে তোলে। আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে এই দায়িত্বের ব্যাখ্যা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তবে তাকে বাধ্য করা হয়নি এসব বিধান ও দায়িত্ব পালনে; বরং সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে—সে তা মানতে পারে কিংবা না-ও মানতে পারে।
সুতরাং আমানত ও খিলাফত মূলত স্বেচ্ছায় আনুগত্যের বিষয়। তাই আমানতের আয়াতের পূর্বে বলা হয়েছে:
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।” (সূরা আহ্যাব, আয়াত ৭১)
আদমের বংশধরদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যারা এই স্বেচ্ছাধীন আনুগত্য পালনে অগ্রগণ্য হয়েছেন—যেমন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা আ. মুহাম্মাদ সা. এবং মরিয়ম, খাদিজা, আয়েশা রাযি. -সহ অন্যান্য নবী ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আবার অনেকে ব্যর্থ হয়েছে—যেমন কাবীল, নমরূদ, ফেরাউন, আবু লাহাব ও আবু জাহেল।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে আমানত ও খিলাফত গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েছেন, কিন্তু তাকে এতে বাধ্য করেননি। তাই প্রথমে এটি মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যাতে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিন্তু আসমান, জমিন ও পর্বতসমূহ এই স্বেচ্ছাধীন আনুগত্য পালনের উপযুক্ত ছিল না, তাই তারা নিজেদের অসামর্থ্য স্বীকার করে এই ভারী দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে মানুষ নিজের সক্ষমতা বিবেচনা করে এই দায়িত্ব গ্রহণে অগ্রসর হয়, যদিও সে নিজের প্রতি চরম জুলুম করেছে এবং আমানতের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত অজ্ঞ ছিল। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“নিশ্চয়ই সে খুবই জালিম ও অজ্ঞ।”
এখানে “জুলুম” দ্বারা বোঝানো হয়েছে—কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা, আর “জাহালত” দ্বারা বোঝানো হয়েছে—জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাব। অর্থাৎ মানুষ এই আমানত গ্রহণের মাধ্যমে এমন এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, যা তার জন্য প্রচুর কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। যদি সে তার জ্ঞানগত সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে আমানতের প্রকৃতি ও তা পালনের কঠিনতা উপলব্ধি করত, তবে সে হয়তো এ সিদ্ধান্ত নিত না।
তবে এই সাহসিকতাই মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির মূল রহস্য। যদি সে ঝুঁকি না নিত, তবে তার সুপ্ত ক্ষমতা প্রকাশ পেত না। আর যখন সে বিপদের সম্মুখীন হয়, তখন প্রকৃত সফল ও ব্যর্থদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সত্য পরবর্তী আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে:
“যাতে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের আযাব দেন। আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ” (সূরা আহ্যাব, আয়াত ৭৩)
||
সারসংক্ষেপ:
মানুষ তার দক্ষতা ও যোগ্যতার কারণে আমানত গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে এর পরিণতি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারেনি এবং তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে সে মুনাফিকতা ও কুফরের ফাঁদে পড়ে এবং আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তির উপযুক্ত হয়েছে। তবুও আল্লাহ তাআলা তাকে বারবার তাওবার সুযোগ দিয়েছেন। যারা এই সুযোগ গ্রহণ করেছে, আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করে দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন—যেমন আদম আ. ও অন্যান্য নবী-রাসূল ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়:
খিলাফতের আয়াত কেন মানুষের প্রশংসা করেছে, আর আমানতের আয়াত কেন তাকে তিরস্কার করেছে?
উত্তর হলো—এই দুটি আয়াতের প্রসঙ্গ ভিন্ন। খিলাফতের আয়াতে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে যে, খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ মানে হলো নূহ, ইবরাহীম আ. ও মুহাম্মাদ সা. এর মতো উন্নত হওয়া।
অন্যদিকে আমানতের আয়াতের প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখানে মুনাফিক ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্র উন্মোচন করা হয়েছে। তাই এখানে “জালিম” ও “জাহিল”—এই দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং মুমিনদের তুলনায় মুনাফিক ও মুশরিকদের পরিণতি প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি কেউ কুরআন অধ্যয়ন করে, তবে দেখতে পাবে যে, মানুষের বিপথগামিতার মূল কারণ জুলুম ও জাহালত। যেমন আল্লাহ তাআলা আদম আ. ও তার স্ত্রীকে বলেছিলেন:
“এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না, নতুবা তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
তারা যখন তাওবা করল, তখন বলল:
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি।”
নূহ আ. কে বলা হয়েছিল:
“আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, যেন তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও।”
ইউসুফ আ. বলেছিলেন:
“যদি তুমি তাদের চক্রান্ত আমার থেকে দূর না করো, তাহলে আমি তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ব এবং আমি জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।”
———————
# তাফসির
লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।