AkramNadwi

আল্লাহর নাম, গুণাবলী এবং কর্মসমূহ ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5756

بسم الله الرحمن الرحيم.

ড. জিনান ইউসুফ বুস্তাকি, যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং আমার মেধাবী ছাত্রীদের একজন, আল্লাহর নাম সম্পর্কে ইংরেজি ভাষায় একটি বই রচনা করেছেন, যা ব্যাপক উপকারে এসেছে। তিনি আমাকে লিখেছেন:
“আসসালামু আলাইকুম, শাইখ! আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সেই হাদিস পড়ছিলাম যেখানে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ হলেন المسعر (মূল্য নির্ধারক)।’ এই নামটি শুধু এই হাদিসেই উল্লেখিত হয়েছে। কিছু মানুষ মনে করেন যে এটি আল্লাহর নামগুলোর একটি। আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছি। আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন এবং আপনার মাধ্যমে উপকৃত করুন।”

|| উত্তর:

উত্তর দুটি অংশে বিভক্ত: হাদিসের তাখরিজ (উৎস নির্ধারণ) এবং এর ব্যাখ্যা।

তাখরিজ (উৎস নির্ধারণ):
ইমাম তিরমিজি তাঁর “জামে তিরমিজি” তে, “বুয়ু'” অধ্যায়ে “মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে অধ্যায়” অংশে বর্ণনা করেছেন:
আমাদেরকে মুহাম্মদ ইবনে বাশশার, হজ্জাজ ইবনে মিহাল, হাম্মাদ ইবনে সালামা হাদিস শুনিয়েছেন, তিনি কাতাদা, সাবিত ও হামিদ থেকে, তাঁরা আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। লোকেরা বলল: “হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করুন।” তিনি বললেন:
“নিশ্চয় আল্লাহ হলেন المسعر (মূল্য নির্ধারক)কাবিজ (القابض), বাসিত (الباسط) এবং রাযযাক (الرزاق)। আর আমি আশা করি যে, আমি আমার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব এমন অবস্থায় যে, তোমাদের মধ্যে কেউ আমার থেকে কোনো জুলুমের প্রতিশোধ চাওয়ার মত অবস্থায় থাকবে না, রক্ত বা সম্পদের বিষয়ে।”
আবু ঈসা (তিরমিজি) বলেছেন: এটি একটি হাসান সহিহ হাদিস।

এটি আবু দাউদ তাঁর “সুনান আবু দাউদ”-এ “ইজারা” অধ্যায়ে “মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে অধ্যায়” অংশে উসমান ইবনে আবি শাইবাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “আমাদেরকে আফফান, হাম্মাদ ইবনে সালামার থেকে হাদিস শুনিয়েছেন,” এবং ইবনে মাজাহ তাঁর “সুনান ইবনে মাজাহ”-এ “তিজারত” অধ্যায়ে “মূল্য নির্ধারণ অপছন্দকারী সম্পর্কে অধ্যায়” অংশে মুহাম্মদ ইবনে আল-মাসনা থেকে বর্ণনা করেছেন। এভাবে আহমদ ইবনে হাম্বলসহ অন্যরাও একই সূত্র থেকে এটি বর্ণনা করেছেন।

|| ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “বলুন: তোমরা আল্লাহ নামে অথবা রহমান নামে ডাকো। যেই নামেই ডাকো না কেন, তাঁর জন্যই রয়েছে সর্বোৎকৃষ্ট নামসমূহ।” (সূরা ইসরা ১১০)।
আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে সেইসব গুণাবলী ও বর্ণনা দিয়ে বর্ণনা করি, যা তিনি নিজে নিজের জন্য উল্লেখ করেছেন এবং যা তাঁর রাসূলগণ উল্লেখ করেছেন। এগুলোতে কোনো তাফসির বা তুলনা করা হয় না। এবং এতে কোনো বিকৃতি বা অস্বীকার করা হয় না। “তাঁর মত কোনো কিছুও নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা শূরা ১১)।
আমরা দেখছি, যে সমস্ত বর্ণনা তাঁর জন্য এসেছে, সেগুলো তাদের প্রকৃত অর্থেই গ্রহণ করা হয়। এগুলোর প্রকৃত অর্থ থেকে সরে গিয়ে বাতিনপন্থী, আধুনিকতাবাদী কিংবা পথভ্রষ্ট লোকেরা যে ব্যাখ্যা প্রদান করে, তা বিভ্রান্তিকর। আমরা আল্লাহর কিতাবের সুস্পষ্ট আয়াতগুলো অনুসরণ করি এবং অস্পষ্ট অংশের জ্ঞান আল্লাহর কাছেই সমর্পণ করি। আমরা নিজস্ব মতামত কিংবা কল্পনায় এর ব্যাখ্যায় প্রবেশ করি না।

মানুষ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বুঝতে অনেক মতপার্থক্যে জড়িয়েছে। কেউ কেউ এগুলোকে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী অর্থে ব্যাখ্যা করেছে এবং বিভিন্ন মতবাদ ও বিপরীত ধারণার উপর ভিত্তি করে এগুলো ব্যাখ্যা করেছে। আমি আমার “সফওয়াতুল আকায়েদ” এবং “সহীহ মুসলিম” এর ব্যাখ্যায় এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছি, যেটা ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে।

এখানে আমি সেই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই যেখানে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর সঙ্গে কর্মের পার্থক্য বিদ্যমান। কর্ম নাম ও গুণাবলীর নিচের স্তরে থাকে। একজন মানুষের কাছ থেকে এমন কিছু কর্ম প্রকাশিত হতে পারে, যা তার জন্য গুণ বলে গণ্য হয় না, যেমন: খাওয়া, পান করা, ক্রোধ, প্রাকৃতিক কাজ। একইভাবে আল্লাহ নিজের জন্য কিছু কর্মের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু নিজেকে এগুলোর মাধ্যমে বর্ণনা করেননি। যেমন: বিভ্রান্তি সৃষ্টি, ফিতনা, প্রতিশোধ, হৃদয় সিল করা, ক্রোধ, হাসি ইত্যাদি। আমরা আল্লাহকে এইসব গুণাবলী দ্বারা বর্ণনা করি না।

যা অনেক মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে, তা হলো, কিছু কর্ম আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কর্ম সম্পাদকের নামধারী শব্দে (اسم الفاعل)। তাই কিছু মানুষ ভেবেছে যে, এগুলোও তাঁর গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। কারণ, আরবরা اسم الفاعل ব্যবহার করে কর্মের অর্থে। যেমন আল্লাহ বলেছেন: “নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।” (সূরা সেজদা ২২)। এবং বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।” (সূরা ইবরাহিম ৪৭)।

তাই আমরা বলি না: “হে প্রতিশোধ গ্রহণকারী,” কিংবা “হে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকারী।” কেউ যেন তিরমিজির হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর নামগুলোর মধ্যে “অলংকারের প্রতিশোধ গ্রহণকারী” শব্দটি দেখে বিভ্রান্ত না হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এই নামগুলোর বিশদ বিবরণ হাদিসে সন্নিবেশিত হয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কথা নয়।

:: আরও ক্রিয়াগুলির মধ্যে একটি হল “المسعر” (মূল্য নির্ধারণকারী), যা আল্লাহর জন্য শুধুমাত্র সেই প্রসঙ্গেই ব্যবহার করা উচিত যেখানে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা বলি: “হে আল্লাহ, হে রহমতকারী, হে জগৎসমূহের পালনকর্তা” এবং এর মতো প্রশংসাসূচক বাক্যাবলী। তবে আমরা ক্রিয়াগুলিকে নামের মতো ব্যবহার করে আল্লাহকে সম্বোধন করি না। তাই, “হে মূল্য নির্ধারণকারী (يا مسعر)” বলা উচিত নয়। বরং আমরা বলি, “নিশ্চয়ই আল্লাহই মূল্য নির্ধারণকারী”। আর যখন আমরা আল্লাহকে আহ্বান করি, তখন বলি: “হে দাতা (يا وهاب), হে রিজিকদাতা (يا رزاق)”।

এ বিষয়ে এবং এর সমর্থনে আল্লাহর এই বাণীকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়: “যদি তাদের মঙ্গল হয়, তবে তারা বলে: এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে; আর যদি তাদের অমঙ্গল হয়, তবে বলে: এটা তোমার পক্ষ থেকে। বল: সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে।” (সূরা নিসা, ৭৮)। তারপর আল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন যে, মন্দ কেবল তার কারণেই ঘটে যে তা ব্যক্তির নিজস্ব কর্মফল: “তোমার কাছে যা কল্যাণ আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তোমার কাছে যা অকল্যাণ আসে তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে।” (সূরা নিসা, ৭৯)।

তাহলে আল্লাহর নামসমূহ, গুণাবলী ও কর্মসমূহ সবই সুন্দর, এগুলোর সাথে কোনো কুৎসিততার সম্পর্ক নেই। আল্লাহ মজলুমদের উক্তি থেকে অতি ঊর্ধ্বে এবং পবিত্র। এই বিষয়টি না বুঝার ফলে অনেকেই মারাত্মক মিশ্রণে জড়িয়ে পড়েছে। তারা বলেছে: আল্লাহ যা কিছু করেন তা-ই সুন্দর। সুতরাং, যদি তিনি কোনো অপরাধ ছাড়াই মানুষকে বিভ্রান্ত করেন এবং শাস্তি দেন, তবে এটিও সুন্দর। এমনকি তারা (আল্লাহ আমাদের এধরনের কথা থেকে রক্ষা করুন) বলেছেন: যদি আল্লাহ মিথ্যা বলেন বা ধোঁকা দেন, তবে এটিও কুৎসিত কিছু নয়।

এই উক্তির শুরুতে কিছু সত্যতা থাকলেও এর শেষ অংশ অত্যন্ত ভ্রান্ত ও ভুল। কারণ, যা কিছু আল্লাহ করেন এবং যা কিছু আদেশ করেন তা-ই কল্যাণকর ও সুন্দর। কিন্তু, অপরাধ ছাড়াই শাস্তি দেওয়ার মতো বিষয়গুলো আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ভয়ানক। তারা যদি কেবল এই কথাটি গভীরভাবে চিন্তা করত: “আল্লাহর নামসমূহ সর্বোত্তম।”

এই বিষয়ের বিশদ আলোচনা দীর্ঘ এবং আমি আশা করি, ভবিষ্যতে কোনো সময় এ বিষয়ে উপযুক্তভাবে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

———
# হাদিস # তা’লীম # তাফসীর।

> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *