AkramNadwi

আখিরাতের অর্থ সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি”

https://t.me/DrAkramNadwi/1542

بسم الله الرحمن الرحيم.

——————–

লোকেরা বলল: “আখিরাত কী?”
আমি বললাম: মানুষ আখিরাতকে বোঝার ক্ষেত্রে বড় রকমের বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এই বিভ্রান্তির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় হিন্দু, অন্যান্য কাফির ও মুশরিকদের মধ্যে। এরপর আসে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অবস্থান। তবে মুসলিমদের বিভিন্ন দল-উপদলের পক্ষ থেকেও আখিরাতের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধিতে ভুল হয়েছে, যদিও তা তুলনামূলকভাবে হালকা।

তারা বলল: “সেই সব দল-উপদলের ভুলগুলো স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরুন।”
আমি বললাম: তারা আখিরাতকে এমন এক বিমূর্ত স্থান ও বিমূর্ত সময় রূপে তুলে ধরে, যা দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং যার সঙ্গে দুনিয়ার কোনো সংযোগ নেই।

উদাহরণস্বরূপ, সুফিগণ “দুনিয়া পরিত্যাগ”-এর ধারণাকে এমনভাবে রূপায়ণ করেছে, যা মানুষকে পৃথিবী গঠন থেকে বিরত রাখতে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা দুনিয়াকে নিন্দনীয় ও ত্যাজ্য হিসেবে তুলে ধরেছে।

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বশীল শক্তিগুলো এই আঁধারাচ্ছন্ন ও বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের বিবেক ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফতের দায়িত্ব ও আমানতের ভার বহনের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

এর ফলে মানুষ এই দুনিয়ার জুলুমপূর্ণ জীবনব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, এর উপর প্রশ্ন তোলে না, প্রতিবাদও করে না; বরং নিরাশ হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর দেওয়া মেধা ও ক্ষমতাগুলো নষ্ট করে ফেলে।

তারা বলল: “তবে আপনি দুনিয়া পরিত্যাগের মতবাদের সমালোচনা করছেন কেন? এটি তো একটি সঠিক বক্তব্য, যেখানে চিরস্থায়ীকে নশ্বরের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘আর নিশ্চয়ই আখিরাত তোমার জন্য দুনিয়ার তুলনায় উত্তম।’ (সূরা আদ-দুহা: ৪)”

আমি বললাম: তোমরা এই আয়াতের অর্থকে খুব বড়ভাবে ভুল বুঝেছ। এই আয়াত দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্বের কথা বলছে না। বরং এটি একটি মহাসত্যের দিকে দিকনির্দেশ করছে—সেটি হলো: মানুষ যেন লক্ষ্য ভুলে কেবল মাধ্যমেই ব্যস্ত না হয়ে পড়ে।

আখিরাত হলো আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও পরম উদ্দেশ্য। আর দুনিয়া হলো সেই উদ্দেশ্য অর্জনের উপায় ও মাধ্যম।
আখিরাতে সফলতা কেবল তখনই আসবে, যখন মানুষ দুনিয়াতে কাজ করবে, পৃথিবীতে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করবে এবং তার উপর অর্পিত আল্লাহর আমানত যথাযথভাবে সম্পাদন করবে।

অতএব, দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে সম্পর্ক হলো—উপায় ও লক্ষ্যর সম্পর্ক, পরস্পরবিরোধী বা দ্বন্দ্বপূর্ণ নয়।

তারা বলল: “তাহলে আপনি কী বলেন সেই সব বড় বড় মনীষীদের বিষয়ে, যাঁদের লেখায় দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে বিরোধের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং যারা মানুষকে দুনিয়ার ব্যপারে বিমুখ হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন?”

আমি বললাম: যুহ্দ (দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি) অবশ্যই কাম্য এবং ইসলামে এর আদেশ রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দুনিয়াই যেন আমাদের প্রধান চিন্তা বা লক্ষ্য হয়ে যায়।

আর দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে বৈরিতা ও পরস্পর বিরোধের যে ধারণা উপস্থাপন করা হয়, সেটি ইসলামের প্রকৃত স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যেটি কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষায় স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, এমন একটি বিখ্যাত হাদীস রয়েছে যা ইমাম আহমদ প্রমুখ সহীহ সনদে আনাস ইবন মালিক রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“কিয়ামত যদি কায়েম হয় এবং তোমাদের কেউ যদি দেখেন যে তার হাতে একটি খেজুর গাছের চারা আছে, এবং সে যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তা রোপণ করতে সক্ষম হয়—তাহলে সে যেন তা রোপণ করে দেয়।”

তারা বলল: “এই হাদীসের অর্থ কী?”
আমি বললাম:
এই হাদীসের অর্থ কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এর শিক্ষা হলো—দুনিয়াই হলো নেক আমল বপনের ক্ষেত্র।
যদি কারও হাতে সময় থাকে, সে যেন নেক কাজ করার সুযোগ হাতছাড়া না করে, কারণ সে তার নিয়ত ও সাধ্য অনুযায়ী পুরস্কৃত হবে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই হাদীস এমন একটি নেক কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দিচ্ছে, যা অনেকেই নিছক দুনিয়াবি কাজ বলে মনে করে। অথচ হাদীস সেই কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ, রুকু, সিজদা, তাওবা বা দোয়ার দিকে ধাবিত হতে বলেনি—যদিও কিয়ামত আসন্ন!

আমি আরও বললাম: যদি যুহ্দের অর্থ হতো দুনিয়াকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা—তাহলে হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্যের আর কোনো প্রয়োজন থাকত না।

কিন্তু যদি তোমরা ইসলাম ধর্মে হালাল-হারামের বিস্তারিত বিধান গভীরভাবে পর্যালোচনা করো, তাহলে পরিষ্কার বুঝবে—এই ধর্মে “দুনিয়া পরিত্যাগ”-এর আহ্বান ইসলামের শিক্ষার সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।

তারা বলল: “তাহলে ইসলামি শিক্ষায় আখিরাত সম্পর্কে চূড়ান্ত বক্তব্য কী?”
আমি বললাম:
আখিরাত হলো আমাদের চিরস্থায়ী আবাস—যেখানে আমরা যাব।
সেখানে আমাদের দুনিয়ার নেক ও মন্দ কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
কেউ পাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি, আর কেউ আল্লাহর অসন্তুষ্টি। কেউ পাবে জান্নাত, আর কেউ জাহান্নাম।

আখিরাতে বিশ্বাস মানুষের অন্তরকে পরিপূর্ণ করে তোলে আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্যে—যা প্রকাশ পায় তাঁর আদেশ ও নিষেধ মানার মাধ্যমে।

সুতরাং, দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে বিরোধ বা বৈরিতা—এই ধারণা ইসলামের কোনো অংশ নয়। বরং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো—আমাদের দুনিয়ার যাবতীয় কাজ যেন আখিরাত মুখী থাকে।

আমরা যেন এই জীবনের কোনো দায়িত্বই পালন না করি—যতক্ষণ না সেটার প্রতিফল বা ফলাফল আখিরাতে কেমন হবে তা ভেবে নিই।
এই চিন্তা মানুষের যোগ্যতা বিকশিত করে, তাকে কর্মঠ করে তোলে, দায়িত্বশীল করে তোলে, এবং বড় বড় চ্যালেঞ্জ ও দুঃসময়ের মোকাবিলা করার শক্তি দেয়—যে কাজ দুনিয়া ও আখিরাত—দুই দিকেই কল্যাণ বয়ে আনে।

তারা বলল: “আখিরাতে অবিশ্বাস বা অস্বীকৃতির পরিণতি কী?”
আমি বললাম: এর সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো—মানুষ তখন সবচেয়ে বড় সত্যকে অবহেলা করে, তার দিকে মনোযোগ দেয় না এবং তার জন্য প্রস্তুতি নেয় না।

ফলে, আল্লাহ না করুন, সে আল্লাহর গজব ও সেই ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে, যা অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য।
এবং এই অবিশ্বাসের জন্য আল্লাহর কাছে তার কোনো গ্রহণযোগ্য অজুহাত থাকবে না।

সুতরাং, ধ্বংস তার জন্য, যে শুধু ধ্বংসের ঘরেই ব্যস্ত থাকে, পাথরের মতো অর্থসম্পদ জমা করায় লিপ্ত থাকে।
ধ্বংস তার জন্য, যে ফানির প্রেমে পড়ে চিরস্থায়ী ঘরের কথা ভুলে যায়।
ধ্বংস সেই হতভাগার জন্য, যে তার চূড়ান্ত পরিণতি—জান্নাত বা জাহান্নাম—কে অস্বীকার করে।
আর কতই না দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি, যার হৃদয় তার রবের দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য আকুল হয় না!

তারা বলল: আখিরাতে অবিশ্বাস (কুফর) কি দুনিয়াতেও কোনো পরিণতি ডেকে আনে?
আমি বললাম: হ্যাঁ, আখিরাতে অবিশ্বাস দুনিয়ার জন্য এক বড় ধরনের বিপর্যয়। এটা মানুষের কর্মপ্রেরণাকে কলুষিত করে এবং কাজের উদ্দেশ্যগুলোকেও অপবিত্র করে তোলে। ফলে আমরা তখন আমাদের দায়িত্বগুলো কেবল ক্ষণস্থায়ী, তুচ্ছ কোনো জাগতিক লাভ, অর্থনৈতিক স্বার্থ অথবা সামাজিক-রাজনৈতিক সুবিধার ওপর ভিত্তি করে পালন করি। যেহেতু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত এবং স্বল্পমেয়াদী লাভ-ক্ষতির মাঝেই আবদ্ধ, তাই এর পরিণতি হয় আত্মার দুর্দশা, চরিত্রের বিকৃতি এবং এ পৃথিবীর ধ্বংস ও দুরবস্থা।
এই কথাগুলোর বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে—আজকের পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি ও অনৈতিকতা।

আমি আরও বললাম: যখন ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাস ও তাত্ক্ষণিক লাভ মানুষের মনে প্রাধান্য পায়, তখন সে দীনার-দিরহামের দাস হয়ে যায়। তখন সে জীবনের সৌন্দর্য দেখার মতো চোখ রাখে না, খেয়াল করে না সবুজ-শ্যামল বাগান, মনোহর ফুল, নদী-সাগর, কিংবা গান গেয়ে যাওয়া পাখিদের প্রতি। তার মন হয়ে পড়ে সংকীর্ণ, বিষণ্ন ও বিষাক্ত। লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতা আর কুপ্রবৃত্তির আধিপত্যে সে রুক্ষ, কঠোর ও কর্কশ হয়ে ওঠে। সে তখন প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দ থেকে বিচ্যুত এক অদ্ভুত সত্তায় পরিণত হয়। ফলে বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তার জীবন হয়ে যায় এক প্রকার জাহান্নাম। সে নিজ চোখে এই দুনিয়াকে কালো দেখতেই থাকে এবং তার চারপাশের মানুষের কাছেও দুনিয়াটাকে কালো করে তোলে।

এমন একজন হতাশাবাদী লোক একবার বলেছিল—
ضحكنا وكان الضحك منا سفاهة
وحق لسكان البسيطة أن يبكو

“আমরা হেসেছিলাম, অথচ আমাদের সেই হাসি ছিল বোকামি।
এই পৃথিবীর সকল বাসিন্দাদের তো আসলে কাঁদাই উচিত।”

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *