https://t.me/DrAkramNadwi/3701
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
আমাদের শ্রদ্ধেয় এবং দয়ালু বন্ধু মাওলানা সৈয়দ ইরফান হাসনী সাহেব নিম্নলিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছেন:
“আকরাম ভাই, সালাম। একজন জিজ্ঞাসু প্রশ্ন করেছেন যে আল্লাহ যখন এত ক্ষমতাশালী যে তিনি একটি মুহূর্তে যে কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারেন, তখন তিনি কেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন? যেমন কুরআনে বলা হয়েছে: ‘خلق السموات والارض فی ستة ايام’ (আল-আ’রাফ: ৫৪)। আবার অন্য জায়গায় উল্লেখ আছে: ‘خلق الارض فی یومین’।”
এই প্রবন্ধটি সেই প্রশ্নের উত্তর।
|| আসমান ও জমিনের সৃষ্টি :
কুরআন কারিমের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী, আসমান ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে। বহু আয়াতে এটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
“নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ, যিনি ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশের উপর স্থির হন। তিনি রাতকে দিনের উপর এনে ঢেকে দেন, যা দ্রুততার সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে। এবং তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারাগুলোকে তাঁর হুকুমের অধীন করেছেন। জেনে রাখো, সৃষ্টিও তাঁর, এবং নির্দেশও তাঁর। মহিমা মহান রব্বুল আলামিনের জন্য।”
(সুরা আল-আ’রাফ: আয়াত ৫৪)
আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেন:
“তিনিই সেই সত্তা যিনি ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, আর তখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। যাতে তিনি পরীক্ষা করেন, তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম।”
(সুরা হূদ: আয়াত ৭)
এক জায়গায় এর বিস্তারিত এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
জমিন সৃষ্টি করতে দু’দিন লেগেছে। এরপর জমিনের উপর পাহাড় স্থাপন করা, তাতে বরকত প্রদান করা এবং সকল খাদ্যের বিধান নির্ধারণ করতে আরও দু’দিন লেগেছে। এটি মোট চার দিন। এরপর আসমান সৃষ্টি করতে দু’দিন লেগেছে। এভাবে সব মিলিয়ে ছয় দিন পূর্ণ হয়েছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন:
“বলুন, তোমরা কি সেই সত্তাকে অস্বীকার করছ, যিনি দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর জন্য সমকক্ষ বানাও? তিনিই সকল জগতের রব। এবং তিনি এর উপর স্থির পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, এতে বরকত দিয়েছেন এবং এতে জীবিকাগুলোর পরিমাণ চার দিনে নির্ধারণ করেছেন – প্রত্যাশীদের জন্য সমানভাবে। তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, যা ছিল ধোঁয়ার মতো। তিনি তাকে এবং পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসো।’ তারা বলল, ‘আমরা ইচ্ছায় আসি।’ তারপর তিনি দুই দিনে সাত আকাশকে পূর্ণতা দিলেন এবং প্রতিটি আকাশে তার কার্যক্রম নির্ধারণ করে দিলেন। আমরা নিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সজ্জিত করেছি এবং এটি সংরক্ষিত করেছি। এটি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞের সিদ্ধান্ত।”
(সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ৯-১২)
“আইয়াম” শব্দের অর্থ :
সৃষ্টির দিনগুলোকে বোঝাতে কুরআন কারিমে “আইয়াম” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। “আইয়াম” হলো “ইয়াওম” শব্দের বহুবচন, যার অর্থ উর্দুতে দিন। এই দুনিয়ায় একটি “ইয়াওম” মানে ২৪ ঘণ্টা, যা সত্য। তবে এটা ভাবা ভুল যে প্রতিটি গ্রহে “ইয়াওম” এর সময়কাল একরকম হবে। বাস্তবেও আরবরা “ইয়াওম” শব্দকে সাধারণভাবে সময় বোঝানোর জন্য ব্যবহার করে। এই কারণেই যুদ্ধগুলোকে “আইয়াম” বলা হয়, এবং এর প্রমাণ আরবি কবিতায় প্রচুর রয়েছে।
এ কথাও সত্য যে “ইয়াওম” ২৪ ঘণ্টার বেশি হতে পারে। এ বিষয়ে কুরআন কারিমেও উল্লেখ রয়েছে। যেমন, আল্লাহর সাধারণ সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে “ইয়াওম” ভিন্ন। এর প্রত্যেক “ইয়াওম” আমাদের হিসেবে এক হাজার বছরের সমান।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“তারা তোমার কাছে শাস্তি তাড়াতাড়ি আনতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। আর তোমাদের রবের কাছে একটি দিন তোমাদের হিসেবে এক হাজার বছরের সমান।”
(সূরা আল-হজ, আয়াত ৪৭)
আখিরাতের দিনগুলোর সময়কাল পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। একইভাবে, ফেরেশতাদের চলাচলের সময়কালও পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।
কুরআনে এসেছে:
“এক জিজ্ঞাসু আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল, যা কাফিরদের জন্য, যা প্রতিহতকারী কেউ নেই। এটি আল্লাহর কাছ থেকে, যিনি উচ্চস্তরের অধিকারী। ফেরেশতারা এবং রূহ তাঁর কাছে উঠে যায় এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। অতএব, তুমি সুন্দর ধৈর্য ধারণ করো। তারা এটিকে দূরে মনে করে, আর আমরা এটিকে নিকটে দেখি। সেদিন আকাশ তামার মতো হয়ে যাবে এবং পাহাড়গুলো রঙিন পশমের মতো হয়ে যাবে। সেদিন কেউ কারও সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে না।”
(সূরা আল-মাআরিজ, আয়াত ১-১০)
একইভাবে, আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিনগুলোও ভিন্ন। এই দিনগুলোর প্রত্যেকটি হয় এক হাজার বছরের সমান, অথবা পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান, অথবা এদের থেকে আলাদা কোনো সময়কাল হবে। কারণ, কুরআনে এর নির্দিষ্ট সময়কাল উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত কথা বলা মানে আল্লাহর নামে অনুমানের ভিত্তিতে কিছু বলা, যা সম্পূর্ণ অনুচিত।
|| ধাপে ধাপে সৃষ্টি করার হিকমত:
এখানে এই প্রশ্ন উঠে আসে যে, আল্লাহ তাআলা তো এক মুহূর্তেরও কম সময়ে সবকিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম, যা “কুন ফায়াকুন” দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন:
“তাঁর বিষয় হলো, যখন তিনি কোনো কিছু ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাকে বলেন ‘হও’, আর তা হয়ে যায়।”
(সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৮২)
তাহলে আল্লাহ তাআলা কেন আসমান ও জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করলেন?
এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নাও যে এই প্রশ্ন কেবল এখানে নয়, বরং তা সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে আল্লাহ তাআলা ধাপে ধাপে কাজ করার পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।
মূলত বিষয়টি হলো, আল্লাহ তাআলার গুণ কেবল “কাদির” হওয়া নয়, তিনি “হাকিম” (জ্ঞানী) এবং “রহিম” (করুণাময়)ও বটে। সৃষ্টিকুল স্রষ্টার থেকে ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের সৃষ্টিতে এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন যেন তাদের মধ্যে স্রষ্টা হওয়ার সন্দেহ না জাগে। অন্যথায় একটি বড় গোমরাহির দরজা খুলে যেত। আর এটি আল্লাহ তাআলার মহান রহমতগুলোর একটি।
এই হিকমত ও রহমতের কারণেই তিনি সৃষ্টিকে দুর্বল বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়ের দিক রেখেছেন। তিনি তাদেরকে কার্যকারণের (কারণ-ফলাফল) নিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের দুর্বলতার কারণে তাদের সৃষ্টিকে ধাপে ধাপে বিভক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি এই শিক্ষা দিয়েছেন যে তাড়াহুড়ো করা ভুল। বরং মানুষের উচিত সব কাজে এবং সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে ধৈর্য ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে কাজ করা।
|| এবং এই সমস্ত হিকমত আরেকটি বড় হিকমতের সঙ্গে সম্পর্কিত, আর তা হলো :
এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করেন। অর্থাৎ, চিন্তাভাবনা ছাড়াই আপত্তি করার পরিবর্তে তাঁরা কারা যারা আল্লাহর সৃষ্টিকর্মগুলোতে গভীরভাবে চিন্তা করে, এবং তাঁর মহত্ত্ব আবিষ্কার করে তাঁর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলার সমস্ত কাজ অসংখ্য হিকমতের সঙ্গে এই মহান পরীক্ষার উদ্দেশ্যও অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন:
“আর তিনিই সেই সত্তা, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, এবং তখন তাঁর আরশ ছিল পানির ওপরে, যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন যে তোমাদের মধ্যে কাজের দিক থেকে কে উত্তম।”
(সূরা হুদ, আয়াত ৭)
আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহ তাআলা যখন সৃষ্টিকে ধাপে ধাপে বিভক্ত করলেন, তখন তা ফেরেশতাদের বোঝার জন্য সহজ হয়ে গেল। এবং প্রতিটি ধাপের সীমাহীন মহত্ত্ব দেখে আল্লাহর অশেষ ক্ষমতা ও হিকমতের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান ও ঈমান বৃদ্ধি পেতে থাকল।
একবার ভাবুন, আমরা মানুষ কীভাবে শিখি? আমরা প্রথমে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, তারপর সামগ্রিক বিষয়গুলো বুঝতে পারি। আমরা ফলাফল নিয়ে চিন্তা করি, তারপর কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করি। যদি এই ধাপগুলো না থাকতো, তবে আমাদের জ্ঞান একেবারেই সাধারণ এবং সরল হতো। তাতে বিস্তৃত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না, এবং গভীরতাও থাকত না।
সারকথা হলো, সৃষ্টি শুধু আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ নয়, বরং এর মধ্যে অসংখ্য হিকমতেরও প্রতিফলন রয়েছে। আর প্রতিটি জিনিসে এত হিকমতের সমন্বয় নিজেই এক অসীম কুদরতের প্রমাণ।
কাজেই সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কতই না মহান!
——–
মূল : > ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
|| মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।