AkramNadwi

অচেনা মৃত বলে ডেকো না। ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5749

بسم الله الرحمن الرحيم.

“মৃত্যুর পর আমরা যদি লজ্জিত হই, তবে কেনো সাগরে ডুবে গেলাম না?
জানাজার জন্য কোনো স্থান থাকত না এবং কোথাও কোনো মাজার তৈরি হতো না।”

:: আজ যোহরের নামাজ আমি অক্সফোর্ড কেন্দ্রীয় মসজিদে পড়েছিলাম। সাধারণত, আমি ইমামের সালামের সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাই, যেন কোনো গরম কয়লার ওপর বসে ছিলাম। কিন্তু আজ কী হলো, কে জানে! নামাজ শেষে পেছনের দিকে গিয়ে সুন্নত নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব জানাজার ঘোষণা দিলেন। আমি তখনই ভাবতে শুরু করলাম—কারো মৃত্যু হলে সাধারণত মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায়। আজ তবে এত কম মানুষ কেন? মনে হলো হয়তো কোনো অপরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
ইমাম সাহেবের কণ্ঠ আমার কানে এলো, মৃত ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ তিকরিতি। নামটি পরিচিত মনে হলো। ভাবলাম, হয়তো ঠিকমতো শুনিনি। এরপর ইমাম সাহেব বললেন, তার স্ত্রীর নাম লিন্ডা তিকরিতি। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল। তিন দশকের বেশি সময়ের স্মৃতি আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘটনাটি গতকাল, অর্থাৎ মঙ্গলবার ১৬ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরির।
আমি দ্রুত সুন্নত নামাজ শেষ করলাম। ছোট ইমাম সাহেব একজন যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি তাদের কথার মাঝে হস্তক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলাম, “মাওলানা! জানাজা কার?” তিনি বললেন, “এই যুবককে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই এবং তার সঙ্গী জানাজার ব্যবস্থা করেছেন।” সেই যুবক আমার পরিচিত ছিলেন। আমি তার কাছ থেকে মৃত ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাইলাম।

আল্লাহ! কী সরলতা, তাদের এতটুকু খবর নেই,
মৃতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, তার কী হয়েছে।

তিনি বললেন, “এটি কোনো এক অচেনা মৃত ব্যক্তি । আমরা তাকে কেয়ার হোম থেকে নিয়ে এসেছি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেখানে একা ছিলেন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার পরিবারের কেউ কি আছে?” তিনি বললেন, “না।” আমি বললাম, “তার স্ত্রী কি এখানে এসেছেন?” তিনি বললেন, “না, হয়তো তিনি কবরস্থানে আসবেন।”

আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। না পরিবারের বা দেশের কেউ উপস্থিত হয়েছেন , না অক্সফোর্ডের পরিচিতদের কেউ , আর না বাইরের কোনো আত্মীয় এসেছেন। কী নিঃসঙ্গ এই মৃত! কী পরিমাণ নিরাসক্ত এই জানাজা!

“তোমাদের শহরে মৃতদেহকে সবাই কাঁধ দেয় না,
আমাদের গ্রামে চালার বেড়াও সবাই মিলে তুলে নেয়।”

আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। শোকে বিহ্বল অবস্থায় পুরনো বন্ধুর জানাজার নামাজ পড়লাম। দিনটা কেটে গেল, কিন্তু মন খুব ভারি হয়ে থাকল। আজ সকালে কিছুক্ষণ কুরআন শরীফের তাফসির নিয়ে কাজ করলাম। তারপর বারবার সেই প্রয়াত বন্ধুর স্মৃতি আমাকে কাঁদিয়ে তুলল।
“আজ আমি খুব কেঁদেছি,
তুমিও হয়তো কেঁদেছো।
নাসির! তোমার সেই পুরনো সঙ্গী,
তোমার মনে নিশ্চয়ই এসেছে।”

প্রবন্ধ লেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না, তবে মনে হলো কিছু না লেখা পর্যন্ত হয়তো শোক কাটবে না।

|| জানুয়ারি ১৯৯১ সালে যখন আমি অক্সফোর্ডে আসি, তখন আমার সঙ্গে অনেক নারী-পুরুষ কাজ করতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন লিন্ডা তিকরিতি। তিনি শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন। কয়েক বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সম্পূর্ণ পর্দার অনুশাসন মেনে চলতেন, খুবই লজ্জাশীল এবং শালীন জীবনযাপন ছিলো তার। সময়মতো নামাজ আদায় করতেন। পুরুষদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতেন না, তবে আমার সঙ্গে একটু বেশি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। তার আরবি ভালো ছিল। কখনো আরবি, কখনো ইংরেজিতে কথা বলতেন।
তিনি কিছু বিষয়ে আমাকে সাহায্য করতেন। কোনো ধর্মীয় সমস্যা হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন। আমাকে একজন আলেম মনে করে সম্মান করতেন এবং আমার মতামতকেই চূড়ান্ত মনে করতেন। একদিন তিনি তার স্বামী মোহাম্মদ ওয়াজীহ তিকরিতির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, এবং সেই পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হলো।

| মুহাম্মদ তিকরিতি সিরিয়ার লাতাকিয়া শহরের বাসিন্দা ছিলেন। হাফিজ আল-আসাদের নিপীড়নের কারণে যেভাবে বহু সিরিয়ান দেশত্যাগ করেছিলেন, তিনিও সেই সময় হিজরত করেছিলেন। তার পরিবার মূলত ইরাকের তিকরিত শহরের বাসিন্দা ছিল। লাতাকিয়া থেকে তিনি অক্সফোর্ডে চলে আসেন এবং উল্লেখিত নও-মুসলিম নারী লিন্ডা তিকরিতির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ মাঝে মাঝে হতো। বেশিরভাগ কথোপকথন ব্যাকরণ ও আরবি সাহিত্যের বিষয়ে হতো। তিনি “إِنَّ رَحْمَةَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِينَ” আয়াতে “قَرِيبٌ”-এর পুংলিঙ্গ হওয়া নিয়ে ইমাম ইবনে মালিকের বিখ্যাত রিসালার ওপর তার গবেষণাসমৃদ্ধ একটি প্রকাশনা করেছিলেন। এর একটি কপি আমাকে দেন, এবং আমি এর ওপর একটি পর্যালোচনা লিখি, যা তার খুব পছন্দ হয়েছিল।
গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে আমরা খোলা প্রাকৃতিক পরিবেশে বিনোদনের জন্য একত্রিত হতাম। মানুষজন তাদের পরিবারের সঙ্গে আসতেন। কাবাব তৈরি করা হতো এবং মাংস ভাজা হতো। তিকরিতি সাহেব এ ধরনের আয়োজনের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন। এ ধরনেরই এক অনুষ্ঠানে একবার তিকরিতি সাহেব আমাকে বললেন যে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত আরবি ভাষার পরীক্ষাগুলোর দায়িত্বে

আছেন। এই পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হয়, আর তিনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যাচাই করতেন।

তিনি বললেন, তার একজন সহকারীর প্রয়োজন। এই কাজটি জ্ঞানসংশ্লিষ্ট এবং এর জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়। তখন আমি ইংল্যান্ডে নতুন এসেছিলাম এবং তেমন কোনো ব্যস্ততা ছিল না, তাই তার প্রস্তাবটি গ্রহণ করি। এভাবে আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতার দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

এই জ্ঞানগত অংশীদারিত্ব আমাদের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করে। তকরিতি সাহেবের বাসায় আমাদের মিটিং হতো। তার স্ত্রী একজন প্রাচ্যের নারীর মতো চা বা কফি তৈরি করতেন, ভদ্রভাবে পরিবেশন করতেন এবং সঙ্গে সিরিয়ার মিষ্টান্নও পরিবেশন করতেন। আমরা দুইজনই পরীক্ষক ছিলাম। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো, সিরিয়ার পরিস্থিতিও আলোচনায় আসত। বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্যের বিষয়গুলো ছিল আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের আলোচনা চলত। অক্সফোর্ডে তিকরিতি সাহেবের মতো বড় ব্যাকরণবিদ আমি আর কাউকে দেখিনি।

কিছু বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদও হতো। যেমন আমি ত্বাহা হুসাইনের প্রশংসা করতাম, কিন্তু তিনি ত্বাহা হুসাইনকে অপছন্দ করতেন। তার অপছন্দের কারণ ছিল ধর্মীয়, এবং সম্ভবত তার শিক্ষকদের প্রভাবও এর পেছনে ছিল।

কেমব্রিজের পরীক্ষাগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়, এবং আরব বিশ্বের ছাত্রদের এই পরীক্ষার প্রতি আগ্রহ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পরীক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানো হয়, এবং আমাদের মিটিং লন্ডন বা অক্সফোর্ডের হোটেলগুলোতে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তিকরিতি সাহেব এই মিটিংগুলোর সভাপতিত্ব করতেন। তার ব্যবস্থাপনার ধরন ছিল সহানুভূতিশীল এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। প্রতিটি বিষয়ে সবার পরামর্শ নিতেন এবং কখনো নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। এই মিটিংগুলো সারাদিন চলত, কিন্তু তিকরিতি সাহেবের সুন্দর আচরণের কারণে আমরা কোনো ক্লান্তি অনুভব করতাম না।

তিকরিতি সাহেবের কাছ থেকে আমি শিখেছি কীভাবে বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা যায়। এই মিটিংগুলোতে যারা অংশগ্রহণ করতেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ পুরুষ ও নারী। তিকরিতি সাহেব ভালো মুসলমান ছিলেন এবং জানতেন কীভাবে অমুসলিম শিক্ষিত শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। তার কোমলভাষিতা সবাইকে তার প্রতি আকৃষ্ট করত। মিটিং পরিচালনায় দক্ষতার ক্ষেত্রে আমি তিকরিতি সাহেবের সমতুল্য কাউকে দেখিনি।

একবার তিকরিতি সাহেব আমাকে তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে প্রধান পরীক্ষক পদ গ্রহণের জন্য চাপ দেন। তিনি বারবার এই প্রস্তাব দেন। আমি বলি যে আমি শুধুমাত্র আপনার জন্য এই কাজে যুক্ত আছি। যদি আপনার পরিবর্তে অন্য কেউ এই পদে আসে, তবে আমি এই কাজ ছেড়ে দেব। আমার এই দৃঢ়তার কারণে তিনি পিছিয়ে যান। প্রায় পনেরো-বিশ বছর আমি এই কাজে তার সঙ্গী ছিলাম। আমার ব্যস্ততা খুব বেড়ে গেলে আমি এই কাজ থেকে অব্যাহতি চাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি আমার অনুরোধ মেনে নেন।

পরীক্ষার কাজ থেকে আলাদা হওয়ার পর খুব কষ্টে এক-দুবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। করোনা মহামারির সময়ে এবং এর পর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমি তাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, বার্তা রেখেছিলাম, কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। আমিও নিজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই তার সঙ্গে দেখা করার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবে মাঝে মাঝে তার কথা মনে পড়ে যেত:

“তোমার কথা এমনভাবে মনে পড়ল,
যেমন কারো সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।”

কয়েকদিন আগে সিরিয়ায় যখন বিপ্লব ঘটল এবং আসাদ পরিবারের শাসন ক্ষমতা উল্টে গেল, তখন আমার তিকরিতি সাহেবের কথা খুব মনে পড়ল। আমি ভাবলাম তিনি নিশ্চয়ই এতে খুব খুশি হয়েছেন এবং হয়তো এবার তিনি নিজের দেশে বেড়াতে যাবেন। মনে হলো তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা উচিত এবং তার সঙ্গে মিলে এই স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করা উচিত।

আমি জানতাম না যে এখন আর তিকরিতি সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। এটি শুধুই আল্লাহর তাওফিক ছিল যে আমি তার জানাজার নামাজ পড়তে পেরেছিলাম। এরপর আমিই পুরনো পরিচিতদের এই দুঃখজনক খবরটি জানিয়েছিলাম। প্রতিটি মানুষ এই আকস্মিক খবর শুনে হতবাক হয়েছিল। কেউ একজন জানিয়েছিলেন যে তিকরিতি সাহেবের পরিবার অক্সফোর্ড থেকে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হয়েছেন। আল্লাহর দয়ায় তাদের ঠিকানা পাওয়া যায়, যাতে অন্তত তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা যায়।

|| এটি সেই ব্যক্তির গল্প, যিনি একসময়ে হয়তো এখানে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার ইন্তেকালের সঙ্গে অক্সফোর্ডে আমার অবস্থানের একটি অধ্যায় শেষ হয়ে গেল এবং জ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেন। আল্লাহ তাকে পরিপূর্ণ রহমত দান করুন।

———-

> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ, যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *